রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 




সম্ভবত মন ও মানার প্রেমকাহিনি



হঠাৎ সেদিন মনের সঙ্গে দেখা। ক্লোজআপে কিছুটা রহস্য। দৃশ্য সরিয়ে অদৃশ্য অয়ন। ভার্চুয়াল বিভ্রম। ভাবছি বিভ্রম কার? তোমার না আমার? স্ফূর্তিলেখা লালবাতিটায় জন্ম নিচ্ছে দ্রোহ। খুব স্পষ্ট নয়। আমি জুম-ইন করি। ফোকাসবিন্দুতে টলটলানো নিউক্লিয়াস। চলন লাগা পা। আরো দ্বন্দ্বের ভেতর আরো সংশয়ের ভেতর দুশ্যাম্পীয় ননরেটিনাল অ্যাব্‌স্ট্রাকশন। তুমি পূর্ণতা চেয়েছিলে দৃশ্যের গায়ে লেগে থাকা প্রতিটা রেখায়। পূর্ণ দৃশ্য। পূর্ণতা কার নাম? ঝিমঝরানো রাত অপেক্ষায় থাকে। এক মুহূর্তের। এক সহসার। কে বলতে পারে সেই মুহূর্ত কতটা কোণ রচনা করে মণিকর্ণিয়ার ঘাটে! তুমি নিশ্চিতের লক্ষ্মণরেখা টেনে সতী ভাবো শক্তি ভাবো। আমি ভাবি আতসের কথা। ওই মুহূর্ত কতটা ঝরালো মন ভিট্রিয়াস হাসিতে, কতটা অস্বীকারে আমির বশ্যতা। আমি নিয়মের ব্যতিক্রম বুনে আকস্মিকের ঘুঙরু বাজাই। অপেক্ষায় থাকি এক মুহূর্তের এক সম্ভাবনার। শব্দেরা সম্ভাবনার কথা বলে। আমি নিঃশব্দে খুঁড়ে রাখি তার বেওয়ারিশ যোনিমুখ। জিভ ছুঁইয়ে দেখো। খুলে যাবে বিভ্রমের জট।  

  

জ.ফু.অ.(জনৈক ফুটকাটা অবিবেচক)─ খাইসে! বেনিয়মের বেন্দাবন বাতলে দিচ্ছে বাৎসায়ন!  



    মন বরাবরই হিসেবি। লেন্সে যতটা প্রতিফলন, তার সঠিক উচ্চারণ। আমি'র রমরমা। তবু বেহিসেবি মানা প্রেমে পড়ল। শুকশারি ঘরদোর বৃষ্টিট্রিস্টি। উড়োপাখি পরিপাটি কাঠামোয় গণ্ডিবদ্ধ। ক্রমশ বিশেষ হয়ে উঠল বিশেষণ। রূপ মাপতে মাপতে মা-এর দলে ভিড়ে গেল। না, মানা মা হতে চায়নি। পরিমিতের দুনিয়ায় তার হাঁপ ধরে এল। ক্লান্ত হয়ে এল কুহু। নিটোল প্রতিমার টোল ভাঙতে ভাঙতে। আঙুলে আঙুল জড়ানো স্বরধ্বনি আলগা হয়ে এল। হিসেবের রোজনামচায় শূন্য। একটার পর একটা। মনের লেন্স কি শূন্যতা দেখতে পায়? অথচ এতবড় আকাশটা শূন্যতারই আর এক নাম। সৃষ্টির ঘরদোর। শূন্যের পরিধি কোনোদিন নির্দিষ্ট হতে দেখিনি। এক নির্বিকার চৈতন্যে ভরাট হয়। ক্রমশ। এক নিস্পৃহ উদাসীনতায় সম্পূর্ণ ভেঙে অসম্পূর্ণ। ক্রমশ। পথিকে যেমন অবস্থান ভেঙে ভেঙে পায়ের উল্লাস। সুপারস্ট্রিঙের ছড়ে বাজানো দৃশ্যে কোনো কথা থাকে না। তরঙ্গ থাকে। আত্মবৃত্তের স্পর্শক বরাবর। যেপথে আমি ঘুরে যাই। ঘুরে ঘুরে পূর্ণ থেকে অপূর্ণের মধ্যমায়। 



জ.ফু.অ.- এ মা সে মা নয় রে গুরু! কলিম খান ঝাড়া 'মাপিত'।



    মনে পড়ে তোমার সেই আবহমান প্রেম। আয়নাফেরত দৃশ্যতায় জলকে চলার অভিযোজন। মানাকে দেখবে বলে আপোশ করতে চায় তোমার চোখের সিলিয়ারি পেশিগুলো। কতটা কমাতে পারো তোমার ওই লেন্সের ফোকাস দৈর্ঘ্য? কতটা দেখতে পাও আমার ভাঙন ধরা ঠোঁটের বৃত্তভ্রষ্ট হাসি? চৈতন্যের ঝাঁপ তুলে মিথিক্যাল মিলিয়ে নিচ্ছে ভালোবাসার ইচ্ছেগুলো। তোমার লালায়িত জিভে নবরসের গলাগলি। স্বরবৃত্তের ধারাবাহিক কতটা ছুঁতে পারে আমার স্তনের ভাঁজে জমানো হৃদি? আমি আয়নিত হতে চেয়েছি বারবার; তুমি আয়নিক হয়ে গেছ। তোমার জায়মানহীন রোল ও বোল আমাকে গেঁথে রাখতে চায় গৃহগণ্ডির লক্ষ্মণরেখায়। গৃহ মানে গণ্ডি নয়। গৃহ মানে স্মৃতি। তুমি কি জানতে? ওড়া এক আকাশের নাম। ভালোবাসারও হতে পারে। ভালোবাসা ও টুকরো রোদ্দুর নিয়ে যায় বহু দূর। যেখানে সত্য ক্রমজায়মান। তোমার আদুরে আঙুল কতটা ছুঁতে পারে আমার পেলব নাভিতলের আলগোছ ভালোবাসা? তোমার জড় শব্দ, দোহার দেওয়া দোয়াব, চিত্র মেলানো চিকন সবই চটকলাগানো চলন্তিকা। গায়ে তার লেগে থাকে প্রতীকের বাহার। শুধু ভালোবাসা রয়ে যায় প্রতীকহীন। মানে না তোমার সাস্যুরিত চিহ্নায়নের সংজ্ঞা। অস্বীকারে স্বেচ্ছাচারে অপর ডেকেছি বারবার। মনের আড়বাঁশি ঠোঁটে বিশুদ্ধ চুমু। আমি নষ্টনীড়ের রং লাগাই ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগে। প্রভু কেন প্রেম দিলে না প্রাণে।



জ.ফু.অ.─ যাচ্চ্‌লে! ইহা প্রেমকাহিনি না নষ্টামির অভিধান! 

    

    সেদিন তোমার বাজিকরী আঙুলে পণ রেখেছিল তিনজন। জন জন আর বিজন ঝাঁপ ফেলছিল। গণকে আকার দাও ইকার দাও, গ্রহনক্ষত্র ফেরে না আর। শুধু গাঢ় হয় চাঁদবিছোনো চাদরে লালবাতির অবৈধ হরফ। তুমি ঘুরে যেতে চাইছো ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট মোডে। নেপথ্যকাহিনিতে কার লাভ বলো? বরং অ্যাপার্চার কমিয়ে আনো। ডেপ্‌থ অফ ফিল্ড বেড়ে গেলে শুনতে পাবে রেখাপারের গল্প। কৃষ্ণনাভির অনিবার্য খাদের গ্র্যাভিটি অগ্রাহ্য করে উঠে আসবে গৃহহীন নগ্নতার গল্প। যদি যুক্তির পথ খোঁজো তবে ওয়ার্মহোলে যেতে পারো। দুহাতে আলোর ফোয়ারা নিয়ে পৌঁছে দেবে নিরাপদর পৃথিবীতে। আমি হেঁটে যাই বিপদগর্ভের গহন অযুক্তি নিয়ে। যেখানে উদোম হচ্ছে তামস। প্রতিদিন। প্রতিরাত। আসলে দেখানেপন আলোয় নারাজ হচ্ছি রোজ। নেগেশনের মন্ত্র নিয়েছি নিজেকে দেখব বলে। মোহমুগ্ধ আলোর সভ্যতা ফেলে রাতভর হেঁটে যাই মনের গহনে, অন্ধকারের অনিশ্চয়ে। থিকথিকে ডার্ক ম্যাটার ঘিরে থাকে আমাকে। চোখ পেতে দেখি এক অন্যট্রন সভ্যতা ঝুলে আছে অসীম শূন্যতায়। নেতি নেতি করে মেতে উঠি ন-করণে। টগ্‌ল করতে থাকি no আর on নিয়ে। নেচে ওঠে আমার শিবসত্তা। নির্মোহ বিনির্মাণে ভেঙে ফেলি আপাত অযুক্তির মোড়ক। জন্মকালীন রক্তমাংসের গন্ধ তীব্র হয়ে উঠলে নির্মাণে ছড়িয়ে দিই লেবু পাতার নির্যাস। নিবিড় নৈঃশব্দ্য নামলে শুনতে পাই টুং শব্দের ননস্টপ অনুরণন। একে একে ঝরে যায় সঙ্গমের অবসাদ। শূন্যের আইহোল থেকে দেখি আঙুলের অণুরেণু কীভাবে বার্তা পায় অনন্তের।

    

    মন দেয়ানেয়া নিয়ে আমরা কিছুটা আদুরবাদুর খেলেছি সন্দেহ নেই। তোমার প্রেমফ্রেমের কাটাকুটি খেলায় কত ভুল চলনের শূন্য বসিয়েছি। বিষণ্ণ রাতের অনিবার্য কালবেলায় রমণীয়তার কত ফ্যাশান শো। রতি ও নিয়তি সমতুল্যে ঝুলে ছিল মানদণ্ডের দুপাশে। প্রাত্যহিক মান, মাপা অভিমান, কিছুটা অনুরাগও বলতে পারো। দলিত মধ্যরাত চাঁদঢলানো হাসি নিয়ে জেগে থাকত আমার ঘুমের সমস্যার পাশে। দ্রোহের পাহাড়ে বসে বুড়ি চাঁদ, হা হা খুলে রাখত ধর্ষিত জরায়ুর অচেনা অন্ধকার। তৃপ্ত তুমি নিদ্রামগ্ন; জানতে পারোনি আমি কেমন বিকল্পনদী এঁকে প্রাণিত করেছিলাম। নদীজলে অলৌকিক মৎসনারী। আমার ঘুমহীন চোখে শুশ্রূষার শিস্‌ দিত। একটা একটা করে তুলে নিত বিঁধে থাকা তির। বিমূর্ত বিদ্যুল্লেখায় গলে যেত তিরচিহ্ন। রাতের নৈঃশব্দ্য ঘিরে বেজে উঠত নিমগ্ন সঙ্গমের প্রিয় শঙ্খধ্বনি। নেচে উঠত একমাত্রায় অসম সমের দ্বিমাত্রা। তবু মধ্যবিত্ত সমকোণ তালিকাভুক্ত করেনি সমকাম।

    

জ.ফু.অ.─ লে হালুয়া! এ যে দেখি বিষমকামের প্রেমফ্রেমে নেতি নেতি করে সমকামের গীত গাইতে বসল রে!

    

    তোমাকে কোনোদিন বলিনি মন, আমার দীর্ঘশ্বাসিত স্বরবর্ণগুলো তোমার হুম-শাসিত ব্যঞ্জনের নীচে কীভাবে নীরবতা খুঁজতে বেরোত ইনফ্রাসোনিক শব্দমহল্লায়। তুমি জানতে পারোনি আমি ওঁকার বুনেছি দিনরাত─ কে তুমি কেন তুমি। যেন তুমি তুমি করেই ঝরে যাবে প্রথার অনুগামী যত চাঁদগলা কুহকের ঢল। কতবার বলেছি, চলো মন দেয়াল ভাঙি, গড়ার আগে। তোমার লাগানো পারদপ্রলেপে ঝাপসা দর্শন। তুমি শুনতে পাওনি। কতবার শুনিয়েছি তোমার পূর্বনির্দিষ্ট কারাগারে শেকলের ঝনঝনানি। তুমুল ভাঙন নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছি সংস্কারের তালা খুলতে। তুমি শুনতে পাওনি। তোমার হলফকাটা সত্যে হাত পেতে দেখেছি ওল্টানো হরতন সব। আলোর সত্যেরা যেমন, অন্ধকারের ভাঁজে লুকিয়ে রাখে প্রিয়তম মিথ্যের মায়া। আসলে, সত্য কোথাও নেই। সত্যকে পিছনে ফেলে এইমাত্র জন্ম নিচ্ছে আরো সত্য। সত্য ক্রমজায়মান। তুমি মানতে চাওনি কোনোদিন।



    তোমার মূল্যবোধের স্থির মানদণ্ডে মানাকে মাপতে চেয়েছ মন। জানতে পারোনি প্রচলিত মূল্যবোধের স্যাঁতানো সূত্রে আমার বরাবরের অনীহা। আমি যতবার নিমফুলের মালা দুলিয়েছি খোঁপায় ও স্তনাগ্রে, তুমি অ্যাক্সানে গেছ রিঅ্যাক্সানের আশায়। নাচার আমি তবু তুলকালাম। বোধের তৌলে তোমার শেখানো মূল্যরা খানখান। কৌটোবদ্ধ তোমার সাজানো সুন্দরের সংজ্ঞাগুলো কতবার ঝাঁকিয়েছি। তুমি শুনতে পাওনি। নতুনের কুরুশকাঁটায় বুনতে চেয়েছি ওল্টানো ঘর, ঘরান্তরিত অভিমান। মূল্যবোধের আসন্ন সংশয়গুলো হাত পা মেলে বসে থাকত আমার প্রগল্‌ভপ্রণালীর পাশে। চলন না-মানা পায়ে ফেলে গেছি যত রীতি যত নীতি। ক্রমশ তুমি অলীক হতে হতে তু্মিহীন মগ্নতায়। 



    মন, মন, মন তোমার কোন চেতনায় বাস? কোথায় আছে তার ঠিকানা? অজানায় কেন মানার মন। কেন সে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা। কেন সে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁধা। হে মন আমার মনগো, তোমার শাহরিক ট্রামলাইনী চেতনায় জিইয়ে রেখেছ একটা গোটা যুগের নির্বাণন্দ। একই জীবন একই আনন্দ। ছেলে ছেলে খেলা। মেয়ে মেয়ে বেলা। আমি যে আর ডুবতে পারি না মন। গত দুদিন বা আগামী দুদিন; চর্চাপদের যেকোনো দিনের সম্ভাব্য সেট খুলে দেখো – মনোরঞ্জন মগ্নতা। তোমার আলোকমণ্ডল ছেড়ে তাই ইদানীং আমি গুহাবাসী। নাভিকুণ্ড ঘিরে চিতার আগুন। দাউ দাউ পুড়ছে অস্তিত্ব। ওই দেখো মন, রঙমহলের বারোয়ারি প্রতিযোগিতা থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সন্ত্রাসীদের দল। নতুনের পায়ে চঞ্চল জল, ছাপছোপ মুছে ছিটকে যাচ্ছে কেন্দ্র থেকে। চেতনা পা ছড়িয়ে এক্সট্রা প্রশ্রয়ে। দেখো মন দেখো, খেলতে নামছে দিগন্তবোধ। ওই শোনো বোধের পাটনি গান ধরল আ-আ-আ-নন্দধারা বহিছে ভুবনে, চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি, প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে... আনন্দ এক অন্তর্বর্তী সেট। এপাশে ওপাশে টাঙানো কিছু আশালীন কুয়াশা, কিছু বিষণ্ণতার রোজনামচা। বদল খুঁজছে কেলাসিত শহরের থিতিয়ে আসা সময়ে। সেটের হাতলে আপৎকালীন শব্দেরা। টেনে রাখছে প্রসারণ ক্ষমতার ছড়। হাইফেনের টানা সড়কে নেচে উঠছে অবস্থানের সংশয়, কালখণ্ডের প্রবণতা। 

    

জ.ফু.অ.─ শালা! প্রেমকাহিনি বলে এখন সাহিত্য মারাচ্ছে!



    আমার সমস্যা তবু জেগে থাকে মন। গরাদের ভেতর। না-ঘুমের ভেতর তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে সূচিমুখ। প্রতিরাতে একটু একটু করে বর্ণান্তর ঘটে যায় সেরিব্রামের কোষকলায়। কোষের মধ্যবর্তী শূন্যস্থান দখলে আসে তোমার। ঘুমহীন ঘোরে বেঘোর হয়ে ওঠে আমার পা। আমি পালাতে চাই। তুমি জানতে পারোনি প্রতিরাতে আমি পালাতে চেয়েছি। এই শহরের আশার ম্যাজিক থেকে। এই শহরের অনিবার্য ঈশ্বর থেকে। জীবনভোর পালানো। তোমার মানা ঈশ্বরকে আমি মানতে পারিনি কোনোদিন। তোমার চিহ্নিত সিঁড়িকে আমি চিনতে চাইনি কোনোদিন। আমি ঈশ্বরকে ক্রমবিকশিত হতে দেখেছি। সংজ্ঞাহীন। প্রয়াসহীন।



জ.ফু.অ.─ কী কেলো মাইরি! এ যে আলখাল্লা খুলে গান ফান গড ফ্রড। প্রেমকাহিনি অনেক হ’ল মামা, এবার আলতো করে শাটার নামা।



    আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে। বহুদূর দূর যেতে হবে……


মন্তব্যসমূহ